২১ শে ফেব্রুয়ারী,
শব্দগুলো শুনলে চোখের সামনে ভেসে উঠে একদল টগবগে তরুনদের মিছিলের চিত্র। যারা ক্রোধে উন্মাদ হয়ে প্রতিবাদ করছে তাদের অধিকারের জন্য, তাদের মায়ের ভাষার জন্য। ভিনদেশের এক বিদেশী ভাষা তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার যে প্রতিক্রিয়া, তা ঝরে পড়ছিলো তাদের চোখ থেকে, ক্ষনে ক্ষনে।
হঠাৎ সামনে থেকে গগনবিদায়ী এক ঝাক শব্দের আগমন।কিছু বুঝে উঠার আগে মুহুর্তে রক্তে রঞ্জিত এই রাজপথ। ভাষার মুল্য হয়তোবা ততক্ষনে বুঝে গেছে এ দেশ।
এর পরের ঘটনা সবারি জানা।সেই রক্তে রঞ্জিত রাজপথের বিনিময় এদেশের মানুষ পেয়েছে কথা বলার অধিকার।কিন্ত রক্তের ওপারে যে কত না বলার গল্প আছে, তা রয়ে গেছে অনেকের অজানা।
মুন্সিগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলার ভিতর ছোট্ট একটি গ্রাম পারিল বলধারা। সেই গ্রামের ভিতর দিয়ে বয়ে গেছে কালিগঙ্গা নদীর একটি শাখার। নদীর জলের মত উথাল পাথাল করত সেই গ্রামের এক মেয়ের মন।করবেই না কেন, তার কৈশোরের প্রেম ছিলো একটি ডানপিটে ছেলে, রফিক। চাচাতো ভাই হবার সত্ত্বেও তার মনের খবর বুঝতে পারত না রফিক। রফিকের অপেক্ষায় দিন কাটত সেই মেয়েটির।
কিন্ত হায়,বিধির বিধান। গাছ থেকে পড়ে গিয়ে চিকিৎসার জন্য ছেলেটি যে কলকাতায় গেল, আর ফিরে আসলোনা। এদিকে কিশোরী মন তো মানেনা, তার এই আকুলতা কাউকে বুঝাতে পারেনা।অব্যাক্ত এক আশায় প্রহর গুনে সেই মেয়েটি। তার এই আকুলতা সৃষ্টিকর্তার কে স্পর্শ করেছিলো।তাই দেশভাগের পর ছেলেটি ফিরে আসে, কলকাতা অসমাপ্ত পড়াশোনা গ্রামে শেষ করে।ততদিন সেই কিশোরীর প্রেম টা আর অব্যাক্ত থাকলোনা, তার আকুলতা ততদিনে বুঝে ফেলেছিলো তার মনের মানুষ টি।
কৈশোর থেকে যৌবন,পরিবারিক ব্যবসা হাল ধরতে ঢাকায় চলে যায় সেই ছেলেটি । পড়াশোনা শুরু করে জগন্নাথ কলেজে। তাই বিরোহের সুর মিশে থাকত তাদের চিঠিতে। কিন্ত একদিন সবাই জেনে যায়।কিন্ত বিপত্তি না বেধে বরং আশীর্বাদ হিসাবে দুই পক্ষ সম্মতি প্রদান করে।নতুন জীবনে স্বপ্ন তখন খেলা করতে শুরু করে সেই তরুন যুগলের চোখে।
প্রেম এর সফলতা বিবাহের মাঝে,তাতে কি খুত রাখা যায়? তাই বিয়ের বাজারের জন্য ঢাকায় আসে সেই যুবকটি।ইচ্ছে ছিলো বাজারের সেরা জিনিস তার হবু স্ত্রী কে উপহার দিবে।এজন্য সারাদিন ঢাকা শহর ঘুরে রাত কাটাতে চলে যায় ঢামেক এর হোস্টেলে।পরেরদিন বিকালে ফিরবে গ্রামে, শুরু করবে এক নতুন জীবন।
২১ শে ফেব্রুয়ারী, বেলা ৩ টা। সকাল থেকে আন্দোলন চলছে,কথা বলার আন্দোলন।সেই আন্দোলন নামক স্ফুলিঙ্গ বেলা বাড়ার সাথে সাথে আগুনে রুপ নেয়।এরপর সেই আগুন ছড়িয়ে যায় সারা রাজপথে।এই আগুনের একটি টুকরো হয়েছিলো রফিকউদ্দিন আহমদ। হবেই না কেন,কথা বলার অধিকার যে বাচিয়ে রাখতে হবে।
আগুন কে নিয়ন্ত্রন না করতে পেরে গুলিবর্ষন শুরু করে শোষক নামক ভীতু জনগোষ্ঠী। মুহুর্তে তাজা রক্তে ভিজে যায় রাজপথ।সেই রক্তের মাঝে ফুটে ছিলো প্রেমের গোলাপ।যে গোলাপ কখনো পুর্নভাবে ফুটে উঠেনি।
আজিমপুর কবরস্থানে গনকবর দেওয়া হয় সেই তরুন কে, মিশিয়ে দেওয়া হয় তার শেষ চিহ্ন কে।কিন্ত গোলাপের অপেক্ষায় পথ চেয়ে ছিলো সেই তরুনী,কখন তার ভালোবাসা পুর্নতা পাবে? কে জানত, ভাষার জন্য ততক্ষনের তার ভালোবাসা অধরেই হারিয়ে গিয়েছে।
ফাগুনের এই প্রহরের অনেক ভালোবাসাই অপুর্ন রয়ে গেল। হয়তোবা তাদের এই অপুর্নতাই আমাদের ভাষাকে পুর্নতা দান করেছে। স্বরন করছি শ্রদ্ধার সাথে সে সকল ত্যাগ কে।
তথ্যসুত্রঃ ১) বিডি নিউজ ২৪ ডট কম
২) প্রথম আলো