বিশ্বজুড়ে ই-কমার্সের যাত্রা; বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত!

বিশ্বজুড়ে ই-কমার্সের যাত্রা; বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত!

বর্তমানে ই-কমার্স শব্দটার সাথে পরিচিত নন এমন মানুষ বোধয় লাখে কতজন আছেন তা গুণে বলে দেয়া সম্ভব। সময়ের সাথে সাথে দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে প্রযুক্তির। আর গত কয়েক দশকে ই-কমার্স তার একটা যুগান্তকারী দিক। মানুষ যত উন্নত হচ্ছে, পাল্টাচ্ছে তাদের জীবনযাপনের ধরন; আর সেই সাথে সহজ থেকে সহজতর হয়ে উঠছে সবকিছু। কেনাকাটাও তার ব্যতিক্রম নয়। গত কয়েক দশকে ই-কমার্সের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা তারই প্রমাণ দেয়।

সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশীয় বিভিন্ন ই-কমার্স সাইটের বিজনেস পলিসি ও সেগুলোর বিতর্ক নিয়ে বেশ হৈচৈ পড়ে যাওয়ায় মানুষ ই-কমার্স সম্বন্ধে আরো বেশি সচেতন হয়ে উঠছে। আমাদের মাঝে  জানার আগ্রহ বাড়ছে ই-কমার্সের আগমন ও এর যাত্রা সম্বন্ধে। সুতরাং, আজ তাহলে চলুন জেনে নেয়া যাক ই-কমার্স আসলে কী এবং যুগ যুগ ধরে ই-কমার্সের বিবর্তনময় যাত্রাটি কেমন ছিল এবং আছে!

খুব সহজ ভাষায়, ই-কমার্স বা ইলেকট্রনিক কমার্স মূলত বোঝায় ইন্টারনেটভিত্তিক প্ল্যাটফর্মে পণ্য কেনাবেচা করা। বাস্তবের কেনাবেচার মতো ই-কমার্সেও ক্রেতা-বিক্রেতা, পণ্য, রশিদ; ইত্যাদি সবই থাকে তবে ট্রান্স্যাকশনের সবকিছুই সম্পন্ন হয়ে যায় শারীরিক উপস্থিতি ছাড়াই! চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে কেনাকাটায় স্রেফ কম্পিউটারের ব্যবহারটা যুক্ত থাকায়, টেলেক্স এর মাধ্যমে পণ্য অর্ডারের তথ্য আদান-প্রদানের ঘটনাকেও অনেকে ই-কমার্সের সূচনা বলে মানেন।

তবে, প্রকৃতপক্ষে ই-কমার্সের যাত্রা শুরু হয় তারও কয়েক দশক পর, যখন মূলত ইন্টারনেট নামক পরশ পাথরের ছোঁয়া পায় মানবজাতি। আর এই ইন্টারনেটকে ভিত্তি করে তখন শুরু হওয়া পণ্য কেনা-বেচাই ছিল আমাদের আজকের ই-কমার্সের সবচেয়ে আদিম চেহারা। 

ই-কমার্সের ব্যাসিক আইডিয়াটা মূলত পণ্য বেচাকেনা হলেও, দিনে দিনে এর প্রকৃতি ও ধরণে এসেছে অজস্র পরিবর্তন। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা, প্রযুক্তির উন্নয়ন আর বিশ্বের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার ক্রয়মুখীতা; এ সকল কিছুর সম্মেলনে ই-কমার্স বা ইলেকট্রনিক ব্যবসা-বাণিজ্য বর্তমান দুনিয়ায় এক অত্যাবশ্যকীয় অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু কেমন ছিল ই- কমার্সের এই বিবর্তন? শুরুতে কেমন ধরণের প্রতিষ্ঠান বা ইন্টারনেটভিত্তিক প্ল্যাটফর্মে ব্যবসা করতো? বর্তমানে ই-কমার্স শুনলেই যেসব প্রতিষ্ঠানের কথা আমাদের মাথায় আসে, সেগুলোই বা কবে থেকে এলো? এ সবকিছুই পরিষ্কার ভাবে জানা যাবে যদি ই-কমার্স দুনিয়ার প্রধান মাইলস্টোনগুলোকে একটা টাইমলাইনের মতো করে সাজাই। তো, আসুন দেখা যাক?

সাধারণ একটা ডায়াল-আপ কানেকশনের মাধ্যমে তৈরি করা CompuServe ছিল ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রির একদম শুরুর দিকের নাম। আশির দশকের প্রথমে, ইমেইলের বেশ কিছু পরীক্ষামূলক সংস্করণ বাজারে আসে তাদের হাত ধরে, এছাড়াও নব্বইয়ের দশক অবধি বিভিন্ন ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি সার্ভিস নিয়ে তাদেরকে বাজারে দেখা যায় যদিও ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র ডক্টর জন এবং জেফরি উইলকিনসের CompuServe তেমন কোনো স্বীকৃত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ছিল না।

যেকোনো ব্যবসার প্রাণ হলো কেনাকাটা। ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মেও তার ব্যতিক্রম ঘটে না। এক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই কেনাকাটার কাজটা সম্পন্ন ইলেকট্রনিকভাবে। আর এই ইলেকট্রনিক কেনাকাটার আবিষ্কারক হলেন মাইকেল অল্ড্রিচ। ১৯৭৯ সালে তার এই অবদানকে বলা যায় ই-কমার্স জগতের স্টেপিং স্টোন।

এর বছর তিনেকের মাঝেই অর্থাৎ ১৯৮২ সালে আত্মপ্রকাশ করে বিশ্বের সর্বপ্রথম স্বীকৃত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান Boston Computer Exchange। এই প্রতিষ্ঠানটি মূলত ইন্টারনেটভিত্তিক এমন একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করতো যেখানে মানুষ সহজেই নিজেদের ব্যবহৃত কম্পিউটার বিক্রি করতে পারতো। তাহলে ভেবে দেখুন, হালের বাই-সেল সাইট বা রিসাইক্লিং গ্রূপগুলোর কনসেপ্ট আসলে কতটা পুরোনো!

১৯৮০-৯০ এর মাঝে ক্রমেই জনপ্রিয় হতে শুরু করে ইন্টারনেট। বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান ইন্টারনেটকে ব্যবহার করার ব্যাপারে ভাবতে শুরু করে। এমনই আরেকটি প্রতিষ্ঠান ছিল Book Stacks Unlimited নামক একটি অনলাইন বুকস্টোর। এটি ১৯৯২ সালে ডায়াল-আপ বুলেটিন বোর্ড ফরম্যাটে আত্মপ্রকাশ করলেও, বছর দুয়েকের মাঝেই ইন্টারনেট ভিত্তিক হয়ে উঠে এবং বুকস ডট কম ডোমেইন থেকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে। সে সময়ে এশিয়ান দেশগুলোতে ইন্টারনেটের ছোঁয়া সেভাবে না লাগলেও পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোতে তখনই বহুলভাবে ইন্টারনেট নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট চলছিলো, যার ফলাফল স্বরূপ তারা এখনো ডিজিটাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরা তে এগিয়ে থাকছে প্রতিনিয়ত।

এতক্ষন বলা যায় ই-কমার্সের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ছিলাম আমরা। এবার ই-কমার্স টাইমলাইনের মধ্য দিয়ে চলুন কিছুটা ফাস্ট ফরোয়ার্ড মোডে ট্রাভেল করা যাক। কেননা, এখন তুলে ধরবো সেসব প্রতিষ্ঠানের জার্নি যারা বর্তমান ই-কমার্সের দুনিয়ায় ভীষণ পরিচিত নাম ও এই ইন্ডাস্ট্রির বড় বড় সব স্টেক হোল্ডার হিসেবে যাদের যাত্রা অব্যাহত আছে।

চলমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় ই-কমার্স জায়ান্ট মানা হয় যে Amazon কে, মার্কেটে সেই Amazon এর আগমন ঘটে ১৯৯৫ সালে। জেফ বেজোসের হাত ধরে একেবারেই ছোট্ট, এক রুমের একটা অফিস থেকে সেসময় যাত্রা শুরু করেছিল এমাজন, যা বর্তমানে ৩১৪.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের নেট ওয়ার্থ নিয়ে বিশ্বের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রির রাজাতুল্য অবস্থানে আছে।

পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালে ই-কমার্স দুনিয়ায় প্রবেশ করে একদমই নতুন ঘরানার একটি প্রতিষ্ঠান, যারা অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেমে বলা যায় বিপ্লব ঘটায়। প্রতিষ্ঠানটির নাম PayPal। পেপাল এসে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর জার্নিকে ভীষণ গতিশীল করে তোলে তাদের সহজ পেমেন্ট মেথডের মাধ্যমে। আজ বিশ্বের অন্যতম বহুল ব্যবহৃত অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম হিসেবে এক বাক্যে পেপালকে গণ্য করা হয়।

পরবর্তী বছরেই আগমন ঘটে বর্তমান ই-কমার্স বিশ্বের আরেক জায়ান্ট আলিবাবা’র। আলিবাবা সম্বন্ধে অল্প শব্দে বলতে গেলেও একটা তথ্য না দিলেই নয়; আর সেটি হচ্ছে, আজ থেকে প্রায় বাইশ বছর আগে ১৯৯৯ সালে ই-কমার্স জগতে প্রবেশকালেই আলিবাবা প্রায় ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে যাত্রা শুরু করে যা তখনকার যুগের ই-কমার্স প্রেক্ষাপটে একটা ভীষণ বড় ও সাহসী পদক্ষেপ ছিল। যদিও সেটার পূর্ণ ইতিবাচক প্রতিফলন এখন আলিবাবা প্রতিনিয়তই লাভ করছে।

এরপর পৃথিবী প্রবেশ করলো একবিংশ শতাব্দীতে। আর এই শতাব্দীর শুরু থেকেই যেন বিশ্ববাসী জেনে গিয়েছিল এখন থেকে দুনিয়াজুড়ে রাজত্ব হবে ইন্টারনেটকে ঘিরেই। ক্রমশ সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হতে শুরু করে ইন্টারনেট, আর সাথে হু হু করে বাড়তে থাকে ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রির পরিধি। ২০০০ সালে Google AdWords, ২০০৪ এ Shopify এবং পরবর্তী বছরগুলোতে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এবং এপলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর এডভারটাইজিং পলিসিতে যাওয়া এবং ধীরে ধীরে এসব সোশ্যাল সাইট ভিত্তিক নতুন আরেক ই-কমার্স সাম্রাজ্য গড়ে উঠা; বলা যায় ২০০০ সালের পরের দুই দশকে, পৃথিবীতে ইন্টারনেট ভিত্তিক বাণিজ্যের বিস্তার যেন আকাশ ছুঁয়েছে। 

আর এরপরই আসে ২০২০ সাল। কোভিড-১৯ এর বছর। গোটা বিশ্ব থমকে যায়। তালা লেগে যায় বিশ্বের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের দরজায়। ঘরে ঘরে আবদ্ধ হয়ে যায় মানুষ। রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, অফিস, আদালত, বাজার-শপিং মলসহ সবকিছু শূন্য হয়ে পড়ে। কিন্তু মানুষের চাহিদা তো থেমে থাকে না! কেনাকাটার চাহিদা মানুষের থেকেই যায়, অথচ করোনার ভয়াল থাবার আতঙ্কে সাধারণ মানুষের পক্ষে বাইরে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল। গোটা বিশ্বের এমন পরিস্থিতি যেন আশীর্বাদ হয়ে নেমে আসে ই-কমার্স দুনিয়ায়। এক বছরের মধ্যে অনলাইন কেনাকাটার জগতে রীতিমতো একটা গ্লোবাল বার্স্ট হয়। লাখো কোটি নতুন কাস্টমার তৈরি হতে থাকে যারা নিয়মিত ইন্টারনেটে কেনাকাটা শুরু করে। বিশ্বব্যাপী লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে অনলাইন বিজনেসের সংখ্যা, এফ কমার্সের জয় জয়কার আরম্ভ হয়, অনলাইন শপিং মার্ট, মাল্টিভেন্ডর প্ল্যাটফর্মগুলো সহ অজস্র নতুন প্রতিষ্ঠানের পদচারণায় মুখরিত হতে থাকে ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি। ২০১৯ এর তুলনায় ২০২০ সালে, গ্লোবালি ই-কমার্স ট্রান্স্যাকশন জাম্প করে এক ধাক্কায় ৭৭% বেড়ে যায়!

সেই আশির দশকে শুরু হওয়া ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রির সাথে আজকের ইন্ডাস্ট্রির তুলনা করতে হলে আদতেই “আকাশ-পাতাল তফাৎ” কথাটার ব্যবহার বাঞ্ছনীয় হয়ে দাঁড়াবে। চারটি দশকের মাঝে এমন যুগান্তকারী এবং ইতিবাচক বিবর্তনের সাক্ষী খুব কম ইন্ডাস্ট্রিই হতে পেরেছে। চতুর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভিউলুশনের দুনিয়ায় প্রবেশ করতে যাচ্ছে বিশ্ব। আধুনিকায়নের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যাবার এই দৌড়ে, বিজনেস এনালিস্টরা ধারণা করছেন ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রির উত্তরোত্তর পরিবর্তন ও উন্নতিটা হবে দেখার মতো। ইন্টারনেটের প্রাক-কালীন আমল থেকে বর্তমানকাল অবধি আসতে আসতে ই-কমার্সের বিপ্লব আমরা দেখেছি। সেটাকে ফ্রেম অফ রেফারেন্স হিসেবে রেখে বর্তমানের পূর্ণ সহজলভ্য ইন্টারনেটের যুগে দাঁড়িয়ে সামনে তাকালে, আগামী কয়েক দশকে ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রির গ্রাফের রেখা যে কেবলই ঊর্ধমুখী হবে; সে ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহের অবকাশই থাকে না।

রিফাত হোসেন দিগন্ত
রিফাত হোসেন দিগন্ত

Recent post